Monday, September 14, 2020

সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা

সাম্রাজ্যবাদের সাথে সাম্প্রদায়িকতার, বিশেষতঃ সমসাময়িক কালের সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদের রয়েছে একটি ভাই-ভাই সম্পর্ক। সাম্রাজ্যবাদ হলো মূলতঃ একটি অর্থনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থা। সমাজ ব্যবস্থার ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধারায় সেটি হলো পুঁজিবাদের একটি চূড়ান্ত রূপ, তার সর্বোচ্চ স্তর। এদিকে, সাম্প্রদায়িকতা হলো মূলতঃ ভাবধারা অবলম্বনে সৃষ্ট একটি সামাজিক-রাজনৈতিক উপাদান। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী তা এক ভয়াবহ জঙ্গিবাদের রূপ নিয়েছে। এতদসত্ত্বেও, সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা পরস্পর যুক্ত এবং তারা পরস্পরকে পরিপুষ্ট করার মধ্য দিয়ে সৃজীত হয়ে থাকে। একথার স্বাক্ষী হলো ইতিহাস। লুটপাটতন্ত্র ও গণতন্ত্রহীনতার পাশাপাশি, সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা হলো আমাদের দেশের সামনে বর্তমানে প্রধান বিপদ।

সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে সম্পর্ক হলো টাকার এপিঠ-ওপিঠের মতো। এগুলো হলো একই বিপদের দুটি আপাতঃ ভিন্ন মুখ মাত্র। একটিকে সাথে নিয়ে (বা বাঁচিয়ে রেখে) অন্যটিকে আঘাত করার কোনো সুযোগ নেই। একটির বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য অপরটির বিরুদ্ধে সংগ্রামকে গৌণ বিবেচনা করাটা, অথবা আপাততঃ স্থগিত রাখার কথা ভাবাটা, শুধু গুরুতর ভ্রান্তিই নয় তা বাস্তবিকভাবে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, সাম্রাজ্যবাদ অথবা সাম্প্রদায়িকতারই সেবা করার মতো কাজে পরিণত হতে বাধ্য।
সমসাময়িক বিশ্ব বাস্তবতায় ‘অখণ্ড বিশ্ব’, ‘গ্লোবাল ভিলেজ’, ‘বিশ্বজনীন পারস্পরিক আন্তঃসম্পর্ক’, ‘এক কেন্দ্রীক বিশ্ব’ ইত্যাদির অভিঘাত বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক ঘটনাবলিতে অবধারিতভাবে এসে পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রেই তা নির্ধারণমূলক উপাদান হিসেবে কাজ করছে। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা হলো বর্তমান বিশ্বের প্রধান ও একচ্ছত্র কর্তৃত্বকারী শক্তি। এই বৈশ্বিক শক্তি কোনোভাবেই এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলকে, দক্ষিণ এশিয়াকে ও বাংলাদেশকে তার স্ট্র্যাটাজির বাইরে যেতে দিতে পারে না। এই অঞ্চলে ভারত একটি বড় শক্তি। আমেরিকান লবিকে সেদেশের নিয়ন্ত্রকের পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে বহু ক্ষেত্রেই ভারতের মাধ্যমে আমেরিকা স্ট্র্যাটাজিক স্বার্থ রক্ষার কাজটি সম্পাদিত করছে। ফলে, সেই ইন্দো-আমেরিকান লবির মোটা দাগের নিয়ন্ত্রণেই বাংলাদেশের ঘটনাবলির গতি প্রকৃতি বহুলাংশে নির্ধারিত হচ্ছে বলে ধরে নেয়াটা খুব ভুল হবে না।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ গোটা বিশ্বকে তার নিয়ন্ত্রণে ও শোষণের জালে আবদ্ধ রাখতে তৎপর রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য হলো তেল সম্পদের বিশাল উৎস। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনি নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখাটা আমেরিকার বিশ্ব স্ট্র্যাটাজির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই উদ্দেশ্যে জায়নবাদী ইসরাইল রাষ্ট্রটিকে লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করার পাশাপাশি মুসলিম দেশগুলোতে, তাদের আজ্ঞাবাহী শক্তির নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে আমেরিকা তৎপর। মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে আমেরিকার নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেন কোনো ‘ইসলামিক আন্দোলন’ শক্তিশালী না হয়ে উঠতে পারে, কিংবা এ ধরনের কোনো দেশ যেন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সেক্যুলার শক্তির হাতে চলে যেতে না পারে- সে বিষয়ে আমেরিকা সজাগ ও তৎপর রয়েছে। ‘সর্প হয়ে দংশন কর, আর ওঝা হয়ে ঝাড়ো’র নীতিও সে প্রয়োগ করে চলেছে। সেজন্যই আমেরিকা মুসলমান প্রধান দেশগুলোতে গৃহপালিত ও নিয়ন্ত্রিত ‘ইসলামী দল’কে মদদ দিয়ে চলেছে।
দেশে দেশে নিজ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য সাম্রাজ্যবাদ নানা কলা-কৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে এদেশে তাদের মূল কৌশলটি কী? বাংলাদেশে তাদের পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য মার্কিনীরা এদেশকে দুর্বল ও অস্থিতিশীল করে রাখতে চায়। সে ক্ষেত্রে ‘নিয়ন্ত্রিত নৈরাজ্যের’ মধ্যে দেশকে নিমজ্জিত রাখাটাই হলো তাদের অনুসরণকৃত কৌশল। সাম্রাজ্যবাদী মহল থেকে বলার চেষ্টা করা হয় যে, জামায়াত কোনো জঙ্গি সংগঠন নয়- এটি হলো একটি ‘উদার ইসলামী দল’। তাদের একথা যে সত্য নয়, তার প্রমাণের অভাব নেই। একথা ঠিক যে জেএমবি, হিজবুত তাহরি ইত্যাদি হলো সন্ত্রাসী সংগঠন। কিন্তু সেই সাথে একথাও ঠিক যে এসব সংগঠনে ক্যাডারের যোগানদাতা, মতাদর্শগত মুরুব্বি, রাজনৈতিক আচ্ছাদন দানকারী হিসেবে যে দলটি কাজ করে সেটি হলো জামায়াত। পরিস্থিতি যেন গণ-বিপ্লবের পথে না যেতে পরে, সেজন্য সাম্প্রদায়িকতা তথা জামায়াত হলো সাম্রাজ্যবাদের শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ। অতএব বলা যায় যে, সাম্প্রদায়িকতা আঘাতপ্রাপ্ত হলে সাথে সাথে সাম্রাজ্যবাদও আঘাতপ্রাপ্ত হবে।
সাম্রাজ্যবাদ জামায়াতকে সে আশ্রয় দিয়ে চলেছে। কারণ, এরূপ সাম্প্রদায়িক শক্তিকে টিকিয়ে রাখতে পারার সাথে সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি যুক্ত। বিশ্বব্যাপী ও দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদের নীল-নকশা বাস্তবায়নে জামায়াত ও এ ধরনের সাম্প্রদায়িক অপশক্তি হলো তাদের ‘রিজার্ভ ফোর্স’ ও ‘পঞ্চম বাহিনী’। সাম্প্রদায়িকতার সাথে সাম্রাজ্যবাদের বিরাজ করে একটি ভাই-ভাইয়ের সম্পর্ক। সাম্রাজ্যবাদের সহায়তা নিয়ে সাম্প্রদায়িকতা দূর করা যাবে না। একইভাবে, সাম্প্রদায়িকতার সাথে হাত মিলিয়ে সাম্রাজ্যবাদকে নির্মূল করা যাবে না। তাই মনে রাখতে হবে, ‘সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে- লড়তে হবে একসাথে’

No comments:
Write Comments

'; (function() { var dsq = document.createElement('script'); dsq.type = 'text/javascript'; dsq.async = true; dsq.src = '//' + disqus_shortname + '.disqus.com/embed.js'; (document.getElementsByTagName('head')[0] || document.getElementsByTagName('body')[0]).appendChild(dsq); })();