Saturday, August 29, 2020

ইয়াজুজ মাজুজের ফেতনা



ইয়াজুজ মাজুজ আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক, বৈবাহিক, অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্য-চিকিৎসা ও ধর্মীয় প্যাটার্ন পরিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের ঘুমের প্যাটার্নও পরিবর্তন করে দিয়েছে।

ইয়াজুজ মাজুজের ফেতনা এতো ভয়াবহ যে এরা রাষ্ট্র থেকে আল্লাহ্‌র আইনকে বিতাড়িত করেছে, আল্লাহ্‌র নির্ধারিত অর্থনীতি বাদ দিয়ে নিজেদের অর্থনীতি চালু করেছে, আল্লাহ্‌ যা হালাল করেছেন তা হারাম করেছে (যেমন, ১৮ বছরের নীচে মেয়েদের বিয়ে), আল্লাহ্‌ যা হারাম করেছেন তা হালাল করেছে (যেমন, সুদ, মদ), মানুষের জন্মকে আটকে দেয়ার চেষ্টা করেছে (জন্ম নিয়ন্ত্রণ), চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা চালু করেছে, ফলে চিকিৎসায় রোগমুক্তি হওয়ার পরিবর্তে চিরস্থায়ী অসুখে মানুষ পতিত হয়েছে (যেমন ডায়াবেটিস, ক্যানসার), আখিরাতের সফলতাকে বাদ দিয়ে দুনিয়ার সফলতাকে হাইলাইট করেছে, আল্লাহর সৃষ্ট বস্তুতে পরিবর্তন করেছে (যেমন, জেনেটিকালি মডিফাইড ফুড), শিল্প কারখানা, মোটরগাড়ি ইত্যাদির মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ করেছে, নদীতে বাঁধ দিয়ে নদীর গতিকে পাল্টে দিয়েছে, ব্যাপক বিধ্বংসী মারণাস্ত্র বানিয়েছে (যেমন, এটম বোম)। তারপরও মানুষরা নাকি ইয়াজুজ মাজুজ দেখে না, ফেতনার জমানা দেখেনা।
ইয়াজুজ মাজুজের দেয়াল ধ্বংস হওয়ার পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত ইসলামী সাম্রাজ্যের বিস্তার মদিনা থেকে সুদূর ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। আমাদের দ্বিতীয় খলিফা উমর রাদ্বিআল্লাহু তায়ালা আ'নহুর শাহাদাতের সময় একটি বিশেষ ফেতনার দরজা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। সম্ভবত সেটিই ছিল সেই ইয়াজুজ মাজুজের ফেতনার দরজা বা প্রাচীর। (যদিও বিপরীত মত আছে, কিন্তু সে মত তো কোরআন হাদিস দ্বারা অকাট্য প্রমাণিত নয়, বরং ইয়াজুজ মাজুজকেই কোরআনে ফেতনার ফ্যাসাদের জাতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর উমর রাদ্বিআল্লাহু তায়ালা আ'নহুর শাহাদাতের মাধ্যমেই পৃথিবী ফেতনা ফ্যাসাদের জমানায় প্রবেশ করে।)
ফলে আমরা দেখতে পাই, মুসলমানদের যে খেলাফত একদা পূর্ব থেকে পশ্চিমে আলো ছড়াতো সে খেলাফত ধীরে ধীরে আঁধারে ঢেকে যায়। এক পর্যায়ে এসে গত শতকে খেলাফত বিলুপ্ত হয়। মুসলমানদের এক জাতি খন্ড বিখন্ড হয়ে পঞ্চাশের বেশি জাতি সৃষ্টি করে।
এর চেয়ে বড় ফেতনা ইসলামী রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আর কি হতে পারে?
আর ব্যক্তিগতভাবে ইয়াজুজ মাজুজের ফেতনা প্রতিটি মানুষকে কামড় দিয়েছে। মানুষকে স্বাভাবিক খাদ্যের পরিবর্তে দূষিত ব্রয়লার ফুড, ফাস্টফুড, টিনজাত খাদ্য, বোতলের পানি খাওয়াচ্ছে। মানুষের বিবাহ সাদি করার স্বাভাবিক অধিকারকে নষ্ট করেছে, এমনকি রাতকে তারা দিনে পরিণত করেছে। ফলে হাজার হাজার বছর ধরে তৈরি হওয়া স্বাভাবিক ঘুমের সার্কেলকেও নষ্ট করে ফেলেছে। মানুষ এখন আর ই'শার পর ঘুমোতে যায় না, তাহাজ্জুদ পড়ে না, সকালে ঘুমের কারনে ফজরের সালাত অনেকে পড়তে পারে না।
Read More

Tuesday, August 11, 2020

ঢাকাকে রাজধানীর মর্যাদা দেওয়ার কৃতিত্ব মোগলদের

৪০০ বছরের ঢাকার বিদেশিরা

ঢাকার প্রথম সেশন জজ শেরম্যান বার্ড ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিশ ১৭৯০ সালে ব্রিটিশ সরকারের কাছে একটি প্রস্তাব দেন। সেখানে তিনি জানান, ব্রিটিশ জাতির জন্য বড়ই লজ্জাকর ঘটনা ঘটে গেছে। বাংলায় ভাগ্যান্বেষণে এসে হাজার হাজার ব্রিটিশ নাগরিক মানবেতর জীবন যাপন করছে। ভবঘুরে ও অপরাধী হিসেবে অনেকে জেলেও নিক্ষিপ্ত হয়েছে। বাংলায় ভাগ্যান্বেষী ব্রিটিশ নাগরিকদের আগমন ঠেকাতে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ওই বছর থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা সরকারের ছাড়পত্র ছাড়া কোনো ব্রিটিশ নাগরিকের বাংলায় আসা নিষিদ্ধ করা হয়। সিরাজুল ইসলাম তাঁর ঐতিহাসিকের নোটবুক বইতে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে দেখিয়েছেন, তখন ব্রিটিশ নাগরিকদের কাছে এমন বিশ্বাস ছিল যে কোনোমতে একবার বাংলামুলুকে পা রাখতে পারলেই কেল্লাফতে।
বাংলার সমৃদ্ধির ইতিহাস কিংবদন্তিকেও হার মানায়। পরশপাথরতুল্য সেই সমৃদ্ধির ছোঁয়ায় নিজেদের ভাগ্য বদলাতে কেবল ব্রিটিশরাই নয়, বরং তাদের অনেক আগে থেকেই ইউরোপের বিভিন্ন জাতি বারবার এসেছে বাংলায়। তাদের অনেকে স্থায়ী বসতও গড়ে তুলেছে। এ প্রসঙ্গে ফরাসির বিখ্যাত পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ারের একটি মন্তব্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলা রাজ্যে প্রবেশ করার জন্য রয়েছে শত দ্বার, কিন্তু বেরোবার জন্য নেই একটিও।’ তিনি ১৬৬৬ ও ১৬৭০ সালে দুবার এসেছিলেন বাংলায়। তখন ইউরোপের ধারণা ছিল, মিসরই বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ। কিন্তু বাংলায় এসে বার্নিয়ারের সেই ধারণা বদলে যায়। বাংলার সমৃদ্ধি দেখে তিনি এ দেশকে বলেছিলেন, ‘বাংলা হচ্ছে বিশ্ব রুপার বেসিন।’ এই সমৃদ্ধিই আলোর আকর্ষণে ছুটে আসা পতঙ্গের মতো পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, আর্মেনিয়ান, ফরাসি, ইংরেজ ও গ্রিকদের টেনে এনেছে এখানে।
বাংলার রাজধানী, মসলিনের শহর, সরু সুগন্ধি চালের শহর, অকল্পনীয় সস্তার শহর ঢাকা হয়ে উঠেছিল তাদের স্বপ্নের শহর—ভাগ্য ফেরানোর ঠিকানা। তাদের অনেকেই আর এই শহরের মায়া কাটিয়ে ফিরতে পারেননি স্বদেশে। এখানেই থেকে গিয়েছিলেন। কালের বিবর্তনে এককালের বিশ্বের সমৃদ্ধতম এই দেশের রাজধানী আজ হতমান। কিন্তু সেই গৌরবের স্মৃতি, ভাগ্যান্বেষণে আসা একসময়ের দরিদ্র, হালের ধনী দেশগুলোর নাগরিকদের নানা স্থাপনা ও নিদর্শন আজও এই মহানগরের গৌরবের দিনগুলোকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
মোগল
ঢাকাকে রাজধানীর মর্যাদা দেওয়ার কৃতিত্ব মোগলদের। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সেনাপতি সুবাদার ইসলাম খান দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এখানে এসে রাজধানীর পত্তন করেছিলেন ১৬১০ সালে। তাঁদের সময়েই ব্যবসা-বাণিজ্যে, শৌর্যবির্যে, নয়নাভিরাম স্থাপনা ও উদ্যানে ঢাকা হয়ে উঠেছিল তৎকালীন বিশ্বের সেরা নগরগুলোর একটি।
ওলন্দাজ
ইউরোপে তখন ভারতের মসলা সোনার চেয়েও দামি। সেই মসলার জন্যই পর্তুগিজদের দেখানো জলরেখা ধরে ভারতে যে দ্বিতীয় ইউরোপীয়দের আগমন, তারা হল্যান্ডবাসী। ঢাকায় তাদের আগমনের তারিখও অজানা। তারা কুঠি স্থাপন করেছিল মিটফোর্ড হাসপাতালের কাছে, ১৬৬৩ সালে। তেজগাঁওয়ে তাদের একটি বাগানবাড়িও ছিল। ওলন্দাজরা ব্যবসা-বাণিজ্যে সফল হতে পারেনি। টেলর উল্লেখ করছেন, ১৭৮৩ সালে ঢাকায় ৩২টি ওলন্দাজ পরিবার ছিল। ইংরেজদের কাছে তারা সহায়-সম্পত্তি তুলে দিয়ে ঢাকার পাট চুকিয়ে ফেলেন। এম হাসান দানীর ঢাকা বইতে উল্লেখ করা হয়েছে, নারিন্দার খ্রিষ্টান কবরস্থানে ১৭৭৫ সালের কুঠিপ্রধান ডি ল্যাংহিটের কবরটিই এখন ঢাকায় ওলন্দাজদের একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে টিকে আছে।
ফরাসি
ঢাকায় ফরাসিদের স্মৃতি বহন করছে পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জ এলাকাটি। ঢাকার নায়েব নাজিম নওয়াজিশ খান ১৭২৬ সালে ফরাসিদের গঞ্জ বসানোর অনুমতি দিলে তারা একটি আবাসন গড়ে তোলে ফ্রেঞ্চগঞ্জ নামে। পরে লোকমুখে এর নাম হয় ফরাশগঞ্জ। তবে এর আগেই ফরাসিদের ঢাকায় আবির্ভাব। সৈয়দ মোহাম্মদ তাইফুর গ্লিম্পসেস অব ওল্ড ঢাকা বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ১৭২৬ সালে ফরাসিরা প্রথম কুঠি করেছিল তেজগাঁওয়ে। প্রধানত মসলিন বস্ত্রের ব্যবসা করত তারা। তবে তারা ইংরেজদের সঙ্গে পেরে ওঠেনি। পলাশীর যুদ্ধের পর এখান থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যায়।
পর্তুগিজ
ইউরোপীয়দের মধ্যে ঢাকায় প্রথম এসেছিল পর্তুগিজরা। ভারতে আসার জলপথ আবিষ্কারের কৃতিত্ব তাদেরই। ভাস্কো দা গামা কালিকট বন্দরে তাঁর জাহাজ ভিড়িয়েছিলেন ১৪৯৮ সালে। উদ্দেশ্য, ভারতের মসলা হাসিল করা। সেই পথ ধরে পরে ইউরোপের আরও অনেকের আগমন। ঢাকায় পর্তুগিজরা প্রথম কবে এসেছিল, তা সঠিক জনা যায় না। পর্তুগিজ পাদির ও পর্যটক মেস্ট্রো ফ্রে সেবাস্টিন মানরিক সপ্তদশ শতকে তিনবার এসেছিলেন বাংলায়। প্রথমবার তিনি ১৬২৮ বা ২৯ সালে আরাকানে যাওয়ার পথে ‘বঙ্গদেশ’ ভ্রমণ করেছিলেন। এর অন্তত ১০০ বছর আগেই বঙ্গদেশে পর্তুগিজদের আগমন ঘটে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন (বঙ্গবৃত্তান্ত: অসীম কুমার রায়, সেবাস্টিন মানরিকের বঙ্গদেশ ভ্রমণ)।
জেমস টেলর তাঁর কোম্পানি আমলে ঢাকা বইতে উল্লেখ করেছেন, ষোড়শ শতকের মধ্যভাগে ঢাকায় পর্তুগিজরা বসতি স্থাপন করে। তেজগাঁও এলাকায় তারা কুঠি স্থাপন করে। তবে পর্তুগিজরা ঢাকায় কত কাল ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে, তা স্পষ্ট নয়। ঐতিহাসিক মুনতাসীর মামুন ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ১৮৩২ সালে ঢাকায় পর্তুগিজদের বাড়ি ছিল ৪১টি। ইসলামপুর, শরাফতগঞ্জ ও নবাবপুরে ছিল তাদের বসবাস।
ইংরেজ
ব্রিটিশরা ভারতে এসেছিল ১৬০০ সালে। ঢাকায় তাদের উপস্থিতি সম্ভবত ১৬৫৮ সালের দিকে বলেই ঐতিহাসিকেরা মনে করেন। পর্তুগিজ ও ওলন্দাজদের পরে আসার কারণে ব্রিটিশরা তখন শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় জায়গা পায়নি। তাদের প্রথম বাণিজ্যকুঠি স্থাপিত হয় শহরতলিতে, বর্তমানের তেজগাঁওয়ের খামারবাড়ি এলাকায়। টেলর উল্লেখ করেছেন, ঢাকায় ইংরেজদের ফ্যাক্টরি প্রথম স্থাপিত হয়েছিল ১৬৬৬ সালে। ব্রিটিশরা চেষ্টা করে সুবাদারের কাছাকাছি থাকতে। কয়েক বছরের মধ্যেই তারা বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে কুঠি স্থানান্তর করে এবং ১৬৭৮ সালে নবাবকে নানা উপঢৌকন দেওয়ার মধ্যমে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতি লাভে সমর্থ হয়। মসলিন বস্ত্র ছিল তাদের প্রধান ব্যবসা। পরের ইতিহাস তো সবারই জানা। মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, ‘দেওয়ানি লাভের পর আরও জাঁকিয়ে বসেছিলেন ইংরেজরা। তখন কুঠির আর প্রয়োজন ছিল না। কারণ পুরো দেশটাই ছিল তখন তাদের।’
গ্রিক
লবণ ও পাটের কারবার করে বেশ টাকাকড়ি করেছিল গ্রিকরা। ঐতিহাসিকদের মতে, ইউরোপীয়দের মধ্যে তারাই ঢাকায় এসেছিল সবার পরে। জেমস টেলর উল্লেখ করেছেন, কলকাতার গ্রিক সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা আরগিরি ঢাকায় বসবাস করতেন এবং ১৭৭৭ সালে তিনি পরলোকগমন করেন। তাঁর পরে অনেকেই আসে। মুনতাসীর মামুন উল্লেখ করেছেন, গ্রিকরা কবে এসেছিল, তা জানা যায় না। তবে ১৮৩২ সালে ঢাকায় ২১টি পরিবার ছিল। ঢাকায় তারা একটি গির্জাও স্থাপন করেছিল। ঢাকার গ্রিকরা স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে বিয়েশাদি করত। তবে তারা স্বল্পায়ু হতো। রেসকোর্সের পাশে ছিল তাদের কবরস্থান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে একটি গ্রিক কবর তাদের স্মৃতিবাহী। ঢাকা ছাড়া নারায়ণগঞ্জেও গ্রিকদের বসবাস ছিল। সেখানে ১৯৫৬ সালে র‌্যালি ব্রাদার্স নামের একটি পাটকল চালু করেছিল র‌্যালি ভাইয়েরা।
কাশ্মীরি
ঢাকায় যেসব কাশ্মীরি ধনে-মানে খ্যাতি ও প্রতিপত্তি অর্জন করেছিল, তাদের মধ্যে ঢাকার নবাব পরিবার অন্যতম। এই পরিবারের আদি পুরুষ আবদাল হাকিম নবাব আলীবর্দী খানের সময়ে প্রথমে বসতি স্থাপন করেছিলেন সিলেটে। পরে তাঁরা ঢাকায় আসেন। লবণ ও চামড়ার কারবারে প্রভূত ধনসম্পদ অর্জন করেন। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম ঐতিহাসিকের নোটবুক বইয়ে উল্লেখ করেছেন, আবদাল হাকিমের ভাই আব্দুল্লাহ সিলেট থেকে ব্যবসা গুটিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। তাঁর পুত্র হাফিজুল্লাহ আর্মেনীয়দের সঙ্গে যৌথ কারবার করে বিত্তবৈভব বাড়িয়ে তোলেন এবং ১৮১২ সালে বাকেরগঞ্জে জমিদারি ক্রয় করেন। নিঃসন্তান হাফিজুল্লাহর পর উত্তরাধিকারী হন তাঁর ভাই খাজা আলিমুল্লাহ। তাঁর পুত্র নবাব আবদুল গনি। ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে বংশপরম্পরায় নবাব উপাধি লাভ করেন। তাঁর পুত্র নবাব আহসানুল্লাহ এবং তাঁর পুত্র নবাব সলিমুল্লাহ। ঢাকায় বিশুদ্ধ পানি ও বিদ্যুৎব্যবস্থা চালুসহ চিকিৎসা, শিক্ষাবিস্তার, সংস্কৃতির চর্চা ও নগর উন্নয়নে এই পরিবারের অবদান বিপুল। তাদের বংশধরেরা এখনো ঢাকায় বসবাস করছেন।
আর্মেনিয়ান
যেমন ফরাশগঞ্জ, তেমনি আরমানিটোলা এবং সেখানকার প্রাচীন গির্জা, পোগজ স্কুল, রূপলাল হাউস ঢাকায় আর্মেনীয়দের স্বর্ণযুগের সাক্ষী দেয়। ঢাকায় ঘোড়ার গাড়ি চালুর কৃতিত্বও তাদের। আর্মেনীয়দের সম্পর্কে বিস্তারিত আছে মুনতাসীর মামুনের হূদয় নাথের ঢাকা শহর বইয়ে। তিনি জানিয়েছেন, ‘আর্মেনীয়দের আগমনের সময় অজ্ঞাত। সম্ভবত সপ্তদশ শতক থেকেই তারা ঢাকায় আসতে শুরু করে। লবণ, পাট ও কাপড়ের ব্যবসায় তারা বিস্তর অর্থবিত্তের অধিকারী হয়। সামাজিক প্রভাবও বেড়েছিল। জমিদারিও কিনেছিল ভোলা, বরিশাল অঞ্চলে।’ উনিশ শতকের প্রভাবশালী আর্মেনীয় পরিবারগুলোর মধ্যে ছিল—পোগজ, আরাতুন, পানিয়াটি, কোজা মাইকেল, মানুক প্রভৃতি। ঢাকায় তারা বেশ কিছু সুরম্য হর্ম্য তৈরি করেছিল বসবাসের জন্য। রূপলাল হাউসের কথা আগেই বলা হয়েছে। বর্তমান বাফা ভবনটি ছিল নিকি পোগোজের বাড়ি। আরমানিটোলায় ছিল তাঁর কুঠি। আরমানিটোলার গির্জাটি নির্মিত হয়েছিল ১৭৮১ সালে। উনিশ শতকের শেষ দিকে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা দেখা দেয়। অনেকেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চলে যায়।
চীনা ও অন্যান্য
চীনারা ঢাকায় জুতার ব্যবসায় বেশ অগ্রগতি লাভ করেছিল। মিটফোর্ড এলাকায় ছিল তাদের কারখানা। এ ছাড়া তারা লন্ড্রির ব্যবসায়ও নিয়োজিত ছিল।
ইরানিরা ঢাকায় আসে সপ্তদশ শতকে। ইরাকিরা এখানে এসেছিল প্রধানত দিল্লি থেকে। তারা মূলত শিয়া সম্প্রদায়ের। হোসেনি দালান ইমামবাড়াকেন্দ্রিক তাদের সম্প্রদায়ের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। ঢাকার বেনারসি কারিগরদের পূর্বপুরুষ এসেছিল ভারতের বেনারস থেকে। মিরপুরে তাদের প্রধান বসতি। তেলেগু সম্প্রদায়ের ঢাকা আগমন উনিশ শতকে। সায়েদাবাদ এলাকায় এখনো তাদের বংশধরদের বসবাস। রাজধানী হিসেবে ৪০০ বছরের মাইলফলক পেরিয়ে গেল এই শহর। আগের মতো ধনবল তার নেই বটে, তবে আছে জনবল। এই জনবল কি পারবে ঢাকার হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনতে?

গ্রন্থনাঃ আশীষ-উর-রহমান
সৌজন্যেঃ প্রথম আলো
PC : Rafiqul Islam Dulal.
Read More