সেই এস কে সুরের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা!
কোন্ এস কে সুর?
মনে কি পড়ে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ১ বিলিয়ন ডলার লুটপাটের কথা? ইনি হলেন সেই সময়কার বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভির দায়িত্বপ্রাপ্ত ডেপুটি গভর্ণর সিতাংশ কুমার সুর চৌধুরী! বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ চুরির সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, এই সুর ছিল তার অন্যতম প্রধান কর্তা। মূলত তার ব্যবস্খাপনায় রিজার্ভ লুটের কাজটি সম্পন্ন করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি হিন্দু চক্র। শুরু থেকে শেষ অবধি ৭/৮ জন হিন্দু সিনিয়র অফিসাররা চুরির কাজটি এমনভাবে করেছে যে, এক জন আরেকজনকে প্রটেক্ট করেছিল। এরা বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স ডিলিং রুম থেকে ১ বিলিয়ন ডলারের পেমেন্ট অর্ডার ইস্যু করে আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে পাঠায়, নির্দেশ পেয়ে সেখান থেকে টাকা চলে যায় ফিলিপাইনের ব্যাংক ঘুরে ক্যাসিনো মার্কেটে। তারপরে নিখোঁজ হয়ে যায় বাংলাদেশের জনগনের রিজার্ভ!
এই হিন্দু চোর চক্রটি (সাথে কিছু মুসলমান কর্মকর্তাও ছিল) কেবল পেমেন্ট অর্ডার ইস্যুই করেনি, গভর্নর আতিউর রহমান খবর জানার পরে তাকে পুরো বিষয়টি ধামাচাপা দিতে এরা বুদ্ধি দেয়। এদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তি হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্ণর এস কে সুর এবং ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিটের জিএম দেবপ্রসাদ দেবনাথ। আর পুরো ঘটনার মূলে ছিল রাষ্ট্রক্ষমতার মূল ব্যক্তির পুত্র, যার কারণে ৪ বছর পার হয়ে গেলেও কোনো তদন্ত বিচার কিছু হয়নি।
আসুন চক্রটিকে চেনা যাক:
১) সিতাংশু কুমার সুর চৌধুরী, ডেপুটি গভর্নর, ফরেক্স রিজার্ভ বিভাগ~ এই ডেপুটি গভর্নরের দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের রিজার্ভ রক্ষণাবেক্ষন ও লেনদেনের নিয়ন্ত্রণ। তার অধীনেই থাকত ফরেক্স ডিলিং রুম। এস কে সুরের এবং অধীনস্থ অফিসারদের হাতের ছাপ ও বায়োমেট্রিক্স জমা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে, যাদের হাতের ছাপ দিয়েই পাঠানো হয়েছিল ১ বিলিয়ন ডলারের পেমেন্ট অর্ডার। ফলে সহেজই অনুমেয় এই সুরের জ্ঞাতসারে বা ব্যবস্থাপনায় রিজার্ভ চুরির সকল অপারেশন সম্পন্ন হয়েছে। তৎকালনীর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল পরিস্কার করেই বলেছিলেন, এরা হাতের ছাপ না দিলে শত হ্যাক করেও টাকা চুরি সম্ভব নয়।
২) রাকেশ আস্থানা~ রিজার্ভ চুরির সময় ভারতীয় এই নাগরিক বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি এডভাইজার হিসাবে কাজ করতো, যদিও তিনি কোনো আইটি এক্সপার্ট ছিলেন না। তাকে নিয়োগ করা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিষশেষ সুপারিশে। জয় এবং রাকেশ আমেরিকাতে একই পাড়ায় বাস করতো তখন। রিজার্ভ চুরির খবর ফিলিপাইন থেকে প্রকাশ হবার পরে গভর্নর আতিউর রহমান তড়িঘড়ি করে রাকেশকে বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি কনসালটেন্ট পদে নিয়োগ দেয়। এরপর রাকেশ বলা শুরু করে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট নেট হ্যাক হয়েছে। অথচ সুইফট সিইও বলছে, তাদের নেট হ্যাক হয়নি, বরং সুইফট নেটকে অসৎউদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের লোকেরাই ৩০০০ কম্পিউটারের সাথে যুক্ত করে দেয়! রাকেশ আরও বলছে ফরেক্স ডিলিং রুমের কম্পিউটারে ম্যালওয়ার ও ভাইরাসে ভর্তি, কোনো ফায়ারওয়াল ছিল না। এটা সম্পূর্ণ অবাস্তব বয়ান। কেননা এই সকল মানি ডিলিং কম্পিউটার সর্বদা সিকিউর্ড থাকে। এসব বিষয়াদি দেখার জন্যই রাকেশকে আইটি এডভাইজারের কাজটি দেয়া হয়েছিল। এরপর কনসালটেন্ট নিয়োগ পাওয়ার পরে তড়িঘড়ি করে রাকেশ নির্দেশ দেয় ব্যাংকের সকল কর্মকর্তার কাছে থাকা কম্পিউটার ও ল্যাপটপে তার দেওয়া প্যাচ ইনস্টল করতে। এই চিঠি ইস্যু করে আরেক হিন্দু প্রিন্সিপাল মেইনটেনেন্স ইঞ্জিনিয়ার পংকজ কুমার মল্লিক। তখন ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তাই আশংকা প্রকাশ করে যে, এই প্যাচ বসিয়ে রাকেশ বাংলাদেশ ব্যাংকের সব গোপন তথ্য তাদের কব্জায় নিয়ে গেছে। এমনকি এখন বিভিন্ন মেশিনে যে সব ম্যালাওয়ার পাওয়া যাচ্ছে, তা সবই কৌশলে স্খাপন করেছেন রাকেশ। ভারতীয় এই রাকেশ এডভাইজার থাকতে এবং এত কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার থাকতে ফরেক্স রুমের মেশিনে ম্যালাওয়ার ঢোকার গল্প ছিল স্রেফ অবাস্তব।
৩) দেবপ্রসাদ দেবনাথ, চুক্তিভিত্তিক জিএম, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট: এই ব্যক্তি অবসরে যাওয়ার পরে তাকে চুক্তিতে স্বপদে নিয়োজিত রাখে গভর্নর আতিউর এবং সরকার। পদত্যাগপত্রে গভর্ণর আতিউর রহমান উল্লেখ করে, চুরির খবর ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিটকে জানায়। অথচ এই ডিপার্টমেন্টের কাজ হলো চুরি বা অনিয়ম ধরা এবং টাকা উদ্ধার করা। অথচ জিএম দেবপ্রসাদ গভর্নর আতিউরকে পরামর্শ দেয়, চুরি ঘটনা গোপন রাখাতে। কিন্তু দেবপ্রসাদ কোনো কিছুই করতে পারেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রিজার্ভ চুরির বিষয়টি গোপন না রেখে সরকারকে সাথে সাথে জানালে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমে গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট দ্রুত চাপ দিয়ে পুরো টাকাই ফেরত আনা সম্ভব ছিল। কেননা চুরি হওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপাইনের রিজার্ভ ব্যাংকিং করপোরেশনের জুপিটার শাখায় ঘুরাঘুরি করছিল ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। সাথে সাথে ফিলিপাইনের সেন্ট্রাল ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করলে টাকা পেমেন্ট হতো না, অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা যেতো। দেবপ্রসাদের ইচ্ছাকৃত ঢিলেমীতে পরবর্তীতে ঐ অর্থের বড় অংশ চলে যায় দেশটির ক্যাসিনোতে। আবার ক্যাসিনোতেও সেই অর্থ ছিল ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অর্থাৎ আরো ২০ দিন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে অবহিত করলে শতভাগ টাকা উদ্ধার করা সম্ভব হতো। উল্টো দেবপ্রসাদদের কর্মকান্ড চুরির টাকা তুলে নিতে সাহায্য করে।
৪) দেব দুলাল রায়, সিস্টেমস ম্যানেজার, আইসিটি ও টেকনিক্যাল সার্ভিস, বাংলাদেশ ব্যাংক: আইসিটি বিভাগের প্রধান এই লোক ভারতীয় এডভাইজার রাকেশের পরামর্শ অনুযায়ী রিজার্ভ চুরি করতে সকল টেকনিক্যাল সার্ভিস দেয়। সে-ই জানে কোন্ কোন্ কম্পিউটার ব্যবহার করে চুরির কাজটি সম্পন্ন যাবে, আর কিভাবে মেশিনের সেই লগ মুছে দেয়া যাবে। তাই করেছিল।
৫) দেবাশীষ চক্রবর্তী, জিএম, ফাইনান্সিয়াল স্টাবিলিটি ডিপার্টমেন্ট: এই ব্যক্তির দায়িত্ব ছিল ফরেন একচেঞ্জ মনিটর করা। রিজার্ভ চুরি করতে তার সাহায্য অবশ্যই লাগবে।
৬) শুভঙ্কর সাহা, নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ~ রিজার্ভ চুরির ৩ মাস আগে শুভঙ্কর সাহাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নিয়োগ করা হয়। এর দু’ মাস আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাউন্টার থেকে ৫ লাখ টাকার ক্যাশ চুরি করে হাতে নাতে ধরা পড়ে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার কর্মকর্তা দীপক চন্দ্র সাহা। তখন চোর দীপককে পুলিশে না দিয়ে ছেড়ে দেয়া এই শুভঙ্কর সাহা। জানানো হয়নি গভর্নর আতিউরকে। ২ দিন পরে পত্রিকা পড়ে জানতে পারেন গভর্ণর আতিউর! এই শুভঙ্কর চুরির সময় ও আগে পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে সকল প্রেস ব্রিফিং করে থাকত। অনেকেই বলেন, রিজার্ভ চুরির খবরাদি গোপন করতে এই লোক মিডিয়া ও জনগনকে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ দিয়েছে!
এই সব চোরগুলাকে নিয়োগ, পদোন্নতি, এমনকি অবসরের পরেও গুরুত্বপূর্ন পদে নিয়োগ দিয়েছিল গভর্নর আতিউর রহমান। দীর্ঘদিনে রিজার্ভ লুটের পরিকল্পনার পুরো বিষয়টি স্থানীয়দের সাথে আন্তর্জাতিক মানিলন্ডারদের সাথে সমন্বয় করে রাষ্ট্রক্ষমতার প্রধান ব্যক্তির পুত্র, তার সাথে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরাও একাধিক মিটিং করে। বেছে নেয়া হয় জুয়ার স্বর্গরাজ্য ফিলিপাইনকে। আতিউর মূলত ভারতীয় লবির লোক, আর তাই সে দিল্লির প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী প্রায় অর্ধশতাধিক হিন্দু অফিসারদের বাংলাদেশ ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ রিজার্ভ, ট্রেজারী, আইসিটি, এগ্রিকালচারাল ক্রেডিট ডিপাটমেন্টে নিয়োগ ও পদায়ন করেছিল। এসব বিষয় তদারকি করার কাজটি করেনি কেউ। কার সবকিছুই হয়েছিল পরিকল্পনামাফিক। তাই গরীব দেশের রিজার্ভ লুট হয়েছে, কিন্তু টাকা উদ্ধার হয়নি, মামলার তদন্তও হয়নি, বিচার তো দূরের কথা।
সেই এস কে সুর এতদিন পরে বাটে পড়েছে ব্যাংকিং খাতের আরেক জালিয়াত পিকে হালদারের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট ও পাচারে সহায়তাকারী হিসাবে। ভালো করে তদন্ত করলে দেখা যাবে, রিজার্ভ লুটের সাথেও পি কে হালদার জড়িত!